সোনালী ক্যামেলিয়া

 সোনালী ক্যামেলিয়া

 

ইউরোপের উদ্ভিদ-শিকারিরা নতুন নতুন উদ্ভিদের খোঁজে সারা বিশ্ব ঘুরে বেরিয়েছেন। যেমন ওয়েস্ট ইন্ডিজে আঁখের খেত-মজুর দাসদের জন্য খাদ্য সংস্থানের খোঁজে ইতিহাস খ্যাত উদ্ভিদবিদ স্যার জোসেফ ব্যাংকস ক্যাপ্টেন উইলিয়াম ব্লিঘকে এইচ এম এস বাউন্টি নামক নেভির এক জাহাজে করে তাহিতি দ্বীপে পাঠান। সেখান থেকে ব্রেডফ্রুটের (রুটি ফল যা কাঁঠালের মত দেখতে, তবে ভিতরে আলুর মত, এক সুষম খাদ্য, উপরে ছবি।) বীজ নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে তা রোপণ করার অভিযানে বেরিয়ে ব্লিঘ বিদ্রোহের মুখে পড়েন। দেশে ফিরে এসে তিনি দ্বিতীয় বার অভিযান করে উদ্দিষ্ট কাজ সমাধা করতে পারেন। এরকম বিভিন্ন দেশের উদ্ভিদের খোঁজ পেলে তার চারা দেশে নিয়ে আসার মতো প্রযুক্তি তখন জানা ছিল না। তাই বিশিষ্ট অঙ্কণশিল্পীরা তা ক্যানভাসে আঁকতেন এবং দেশে নিয়ে এসে তার সংবাদ পৌঁছে দিতেন। এক ব্রিটিশ উদ্ভিদবিদ জেমস কানিংহাম অষ্টাদশ শতাব্দিতে চিনে উদ্ভিদের খোঁজে দুই বার পর্যটন করেন। প্রথম বার আময় বন্দরে অনেক মাস থাকার সৌভাগ্য হয় তাঁর। তিনি আবিষ্কার করেন যে চিনা অঙ্কণশিল্পীরা চারা, ফুল এবং গাছের প্রায় জীবন্ত ছবি আঁকতে দক্ষ ছিলেন। উদ্ভিদ সংগ্রাহকরা সেই সময় নতুন উদ্ভিদের বীজ প্রচুর পরিমাণে সংগ্রহ করতেন। এর সঙ্গে ‘শুকনো নমুনা’ এবং অঙ্কিত উদ্যানের নমুনা সংগ্রহ করে দেশে নিয়ে আসতেন। কানিংহাম এই ভাবে এক হাজারের বেশি নতুন উদ্ভিদের ছবি নিয়ে দেশে ফেরেন। এই সব সুন্দর উদ্ভিদ এবং ফুলের ছবি দেখে ইউরোপের মানুষ বিস্মিত হতো। কানিংহামের সংগ্রহের মধ্যে ছিল হাইড্রাঞ্জিয়াস (নীলাভ ফুলবিশিষ্ট এক গুল্ম), ক্রিসানথেমাম (চন্দ্রমল্লিকা), পুষ্পবতী কুল, পিওনি, বারবার ফোটা গোলাপ, অসংখ্য গারডেনিয়ার নমুনা, প্রিমরোজ, লিলি ইত্যাদি। কিন্তু, একমাত্র ক্যামেলিয়ার জন্য কানিংহামের নাম বিখ্যাত। তবে, এই ফুলের নাম রেখেছিলেন সুইডিশ উদ্ভিদবিদ কার্ল লিনাউস এক মোরাভিয় জেসুইট জর্জ জোসেফ ক্যামেলের নামে। তিনি এশিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চল ভ্রমণ করে অসংখ্য উদ্ভিদের হদিশ দিয়েছিলেন।

 

কানিংহাম বিশ্বাস করতেন যে খাদ্যশস্যের পরে যে জাতীয় উদ্ভিদ মানুষের কাছে সবচেয়ে মূল্যবান তা হলো ক্যামেলিয়া পরিবার। এই পরিবারের সদস্য চায়ের ঝোপ, ক্যামেলিয়া সাইনেনসিস বা চা, যা তখনই বিশাল এবং লাভজনক বাণিজ্য-পণ্যে পরিণত। ক্যামেলিয় পরিবারের অন্য উদ্ভিদের প্রতি কানিংহামের আকর্ষণের কারণ এক চিনা কিংবদন্তী। এক ব্যক্তি এক উপত্যকাতে আবদ্ধ হয়ে পরেন। কথিত যে তিনি ঐ উপত্যকাতে এক শত বছর আটকে ছিলেন শুধু একমাত্র উদ্ভিদ খেয়ে। কানিংহাম শুনেছিলেন এই উদ্ভিদের রঙ ঘন সোনালী এবং ফুলের আধান সেবন করলে সাদা চুল কালো হয়, বৃদ্ধ বয়সের অস্থিসন্ধি নমনীয় হয় এবং ফুসফুসের রোগ নিরাময় করে। কানিংহাম এই ফুলের নাম দেন “সোনালী ক্যামেলিয়া” এবং বিশ্বাস করেন যে সন্ধান পাওয়া গেলে এই উদ্ভিদ মূল্যের দিক দিয়ে চা-ঝোপকেও ছাড়িয়ে যাবে।

 

দ্বিতীয় বার চিন সফরের পর দেশে ফেরার সময় দক্ষিণ ভারতের উপকূলের কাছাকাছি অঞ্চল থেকে কানিংহাম নিরুদ্দেশ হয়ে যান। তাঁর অমূল্য সংগ্রহ তাঁর সঙ্গেই হারিয়ে যায়। সবার অনুমান তাঁর দখলে কিছু সংরক্ষিত উদ্ভিদ ছিল। সেই সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয় যখন জাহাজে ওঠার আগে তিনি যে প্যাকেটটি ডাকে পাঠান তা অবিকৃত অবস্থায় ইংল্যান্ডে পৌঁছায়। সেই প্যাকেটে একটি এক অজানা ফুলের ক্ষুদ্র চিত্র ছিল। ছয় ইঞ্চি বর্গাকারের এক কার্ডে সূক্ষ্ম তুলিতে আঁকা এক কুয়াশাবৃত পাহাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্য। এক প্যাঁচানো সাইপ্রেস গাছের নিচে এক বৃদ্ধ ব্যক্তি হাতে একটি পাত্র নিয়ে বসে আছে। পাশে একটি গাছের শাখাতে ফুটে রয়েছে উজ্জ্বল সোনালী রঙের কিছু ফুল। রোদ লেগে সেই রঙ আরও ঝলমল করছে। সোনালী পাপড়িগুলির মাঝখানে উঁকি দিচ্ছে এক বেগুনি রঙের চোখ। কার্ডের উলটো পিঠে চিনা ভাষায় লেখা সিয়ে লিং-ইউন বা কাং-লো’র রাজা।

 

কাং-লো’র রাজা কোন পৌরাণিক চরিত্র নয়। পঞ্চম শতাব্দিতে তিনি ছিলেন চিনের এক শ্রেষ্ঠ প্রকৃতিবিদ এবং প্রকৃতিপ্রেমী কবি। তাঁর নামের উপরে লেখা রয়েছে সোনালী ক্যামেলিয়া ফুলের ভেষজ গুণ, যা আগে উল্লেখ করা হয়েছে। অনেক বছর পরে কানিংহামের নথিপত্র উদ্ভিদবিদ স্যার জোসেফ ব্যাংকসের হাতে আসে। তিনিও নিশ্চিত হন যে সোনালী ক্যামেলিয়া এক শ্রেষ্ঠ উদ্ভিদবিদ্যার আবিষ্কার হতে পারে। এই উদ্দেশ্যে তিনি সরকারি খরচায় এক প্রশিক্ষিত উদ্যানবিদ উইলিয়াম কারকে ক্যান্টনে পাঠান। উইলিয়াম কার তাঁর সংগ্রহ এক তরুণ উদ্যানপালকের তত্ত্বাবধানে দেশে পাঠান। সেই তরুণ প্রায় অবিকৃত ভাবে সব সংগ্রহ স্যার জোসেফকে দেন। সঙ্গে অনেকগুলি উদ্ভিদের চিত্র ছিল। তার মধ্যে একটিতে অজানা এক ফুলের চিত্র ছিল। ক্যান্টনের এক শিল্পীর আঁকা চিত্রে এক জোড়া ফুল। ফুল দুইটির পাপড়িগুলি সমকেন্দ্রীয় গোলাকার ভাবে ছড়িয়ে আছে। কেন্দ্র থেকে বাইরের দিকে পাপড়ির রঙ উজ্জ্বলতর হয়েছে। ফুলের কেন্দ্রে এক গুচ্ছ কেশর রয়েছে, যার আভা পাপড়ির উপর ছোপ ফেলেছে। উইলিয়াম কার বেশ কয়েক বছর চেষ্টা করেও সোনালী ক্যামেলিয়ার সন্ধান পাননি। তিনি অবশ্য দেশে ফেরেননি। চিনা প্রতিনিধি মারফৎ তিনি কাজ থেকে অব্যাহতি চান।

 

কিংবদন্তীর সোনালী ক্যামেলিয়া কিনা জানি না তবে ১৯৬০ সালে চিনের গুয়াংশি প্রদেশে এক সোনালী রঙের ক্যামেলিয়া (উপরে ছবি) আবিষ্কৃত হয়েছে, যার বৈজ্ঞানিক নাম ক্যামেলিয়া নিতিদিসিমা। এটি গুল্মের মত বা ৫ মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ গাছের মতো উদ্ভিদে পাওয়া যায়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহে এই উদ্ভিদ চায়ের পানীয় হিসাবে পান করা হয়। ২০১০ সাল থেকে গুয়াংশির কোম্পানিগুলি শুষ্ক সোনালী ক্যামেলিয়া ঔষধি হিসাবে বিশ্বের বাজারে প্রতি কিলোগ্রাম ১,৬০৭ ডলার মূল্যে বিক্রয় শুরু করে।

(ঋণঃ রিভার অফ স্মোক, অমিতাভ ঘোষ এবং অন্যান্য সূত্র।)

Comments